যথারীতি আবহাওয়া দপ্তরের কথা মত প্রবল গরম পড়ে গেছে। আর কয়েকদিনে আরও হু হু করে তাপমাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। গরমের চোখ রাঙানি কি বাঙালির উৎসব পার্বণের আনন্দকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? মোটেই নয়! সামনেই তো ঈদ আর বাংলা নববর্ষ…বাঙালি বরং কোমর বেঁধে তৈরি…
এদিকে যতই ইংরিজি নিউ ইয়ার-এ হুল্লোড় করি, তবু শীতের পাতা ঝরার শেষে, যখন প্রবল কালবৈশাখীর ঝড়ে পুরনো জীর্ণ পাতা উড়ে গিয়ে, ডালে ডালে কচি সবুজ পাতার আগমন হয়, তখনই বাঙালি প্রস্তুত হয় পুরনো বছরের ভুল ত্রুটি দীনতা শুধরে, ভালবাসা আর ভাল থাকার কৃতজ্ঞতা নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে…দীর্ঘ প্রস্তুতিতে শুরু হয় বর্ষবরণ উৎসব (Bengali New Year celebration)…
একই সুরে সুর মিলিয়ে আসে ঈদ (Eid)… পুরনো ভুল কর্মের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা, বাকি যা কিছু ভাল তার জন্যে শুকরিয়া জানানো, এবং সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে পালন হয় রোজা এবং ঈদ…
এই দুই পরবের আনন্দের অংশ হয়ে থাকে নতুন জামাকাপড়, স্বজনদের সাথে সময় কাটানো, একটু স্বাদবদল করে বেড়াতে যাওয়া, আর অবশ্যই যেটা ছাড়া বাঙালির সব উৎসব এর রোশনাই ফিকে…সে হল “খাওয়া দাওয়া”
এই প্রবল গরমেও বাঙালির খাবারের প্রতি ভালবাসা যেমন জাকারিয়া স্ট্রিটে উপচে পড়া মানুষের ঢলে মিশে থাকে, তেমনি বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁর ভিড়েও…আবার অনেকেই হয়তো বাড়িতে নিজের হাতে পঞ্চ ব্যঞ্জন সাজিয়ে খেতে, খাওয়াতে ভালবাসেন। সেই ভেবেই বাঙালির পরম আপন “ঠাকুর বাড়ির” হেঁশেল থেকে কিছু রান্না, আবার মুঘলাই অথবা কাশ্মীরের রসুইখানা থেকে তুলে আনা কিছু খাবার…
এদিকে যতই ইংরিজি নিউ ইয়ার-এ হুল্লোড় করি, তবু শীতের পাতা ঝরার শেষে, যখন প্রবল কালবৈশাখীর ঝড়ে পুরনো জীর্ণ পাতা উড়ে গিয়ে, ডালে ডালে কচি সবুজ পাতার আগমন হয়, তখনই বাঙালি প্রস্তুত হয় পুরনো বছরের ভুল ত্রুটি দীনতা শুধরে, ভালবাসা আর ভাল থাকার কৃতজ্ঞতা নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে...দীর্ঘ প্রস্তুতিতে শুরু হয় বর্ষবরণ উৎসব...
এমন কিছু পদ, যাতে থাকবে মরশুমের ফল সবজির সমাহার, এবং শরীর, মন ও হৃদয় জুড়ানো উপকরণ…
- মোহন পোলাও, ঠাকুর বাড়ির হেঁশেল থেকে
- আম পোস্তর বড়া
- আল হাচ চিকেন, কাশ্মীর থেকে
- শিরমল
- আম দিয়ে শাহি টুকরা, মুঘল দরবার থেকে
মোহন পোলাও
**************
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর নথিভুক্ত করা অনন্য রেসিপি গুলির মধ্যে এটি একটি।
উপকরণ:
৫০০ গ্রাম বাসমতি চাল
২৫০ গ্রাম ঘি
২০ গ্রাম আমন্ড ভিজিয়ে খোসা ছাড়িয়ে স্লাইস করা
৪০ গ্রাম কিসমিস
একটা লেবু
বড় পেঁয়াজ লম্বা স্লাইস করা ৬ টা
চিনি, বা মিছরি ২০০ গ্রাম
দুধ এক বাটি
জাফরান দুই চিমটে
তেজপাতা দুটো
লবঙ্গ গোটা ৫/৭
ছোট এলাচ ১০-১২ টা
দারচিনি এক ইঞ্চি টুকরো
জয়িত্রি আস্ত দুটো ফুল
জায়ফল আর্দ্ধেক টাটকা গুঁড়ো করা
গোলাপ জল
নুন স্বাদ মত
পদ্ধতি:
একটা প্যানে ঘি গরম করে তাতে পেঁয়াজ কুচি ভাজতে হবে, বেশ বাদামি হলে তুলে রাখতে হবে পরে ব্যবহারের জন্যে। অন্য একটি ডেকচিতে ২০০ গ্রাম চিনি আর ২০০ গ্রাম জল মিশিয়ে ফুটতে দিতে হবে, তাতে একটু এলাচ, দারচিনি, জায়ফল গুঁড়ো আর অল্প এক চিমটে জাফরান মিশিয়ে। সঙ্গে কিসমিস ও ফুটবে। প্রায় ১৫ থেকে ১৭ মিনিট ফোটার পর নামিয়ে নিতে হবে।
ওদিকে পেঁয়াজ ভাজার ঘি তে, তেজপাতা লবঙ্গ, ৩/৪ টে এলাচ জয়ত্রী দিয়ে গন্ধ বেরোলে তাতে চালের মাপের দ্বিগুণ জল আর নুন দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। জল ফুটলে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা চাল দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে নাড়াতেও হবে। মিনিট দুই পর দুধ দিয়ে আর একবার নাড়িয়ে বসানো থাকবে ৭/৮ মিনিট। তারপর ঢাকা খুলে আগে থেকে গুলে রাখা জাফরান দিতে হবে। জাফরান দেবার পর বন্ধ থাকবে দু মিনিট.. তারপর ঝরঝরে ভাত ঢেলে রাখতে হবে একটা পাত্রে।
এর পর একটা ডেকচি তে, ওই ভাত এর ১/৪ ভাগ বিছিয়ে তাতে পেঁয়াজ ভাজা, জাফরান গুঁড়ো , চিনির সিরা, কাগজি লেবুর রস, এলাচ গুঁড়ো আর গোলাপ জল ছড়িয়ে দিতে হবে, এভাবে বাকি তিনটে ভাগ ভাত ও লেয়ার করে সাজানো হবে। সব শেষে ওপরে একটু কিসমিস আর বাদামকুচি, আর তারপর ডেকচির মুখ ঢেকে আটা মাখা দিয়ে সিল করে খুব কম আঁচে বসানো থাকবে মিনিট পনেরো। তারপর রেডি গোলাপ গন্ধ যুক্ত মোহন পোলাও.. যা সবার মন জয় করবেই…
আম পোস্তর বড়া
****************
উপকরণ:
আধ কাঁচা আম ৫০ গ্রাম গ্রেট করা
এক বাটি পোস্ত বেশ খানিকটা শক্ত করে বাটা
একটা বড় পেঁয়াজ ছোট ছোট কুচি
কাঁচা লঙ্কা কুচি গোটা ছয়
নুন স্বাদমত
কিসমিস কুচি দুই চামচ
চাল গুঁড়ো এক চা চামচ
আদা মিহি কুচি এক চা চামচ
পদ্ধতি:
একটা পাত্রে সব উপকরণ একসাথে মিশিয়ে চ্যাপ্টা বড়ার আকার দিয়ে গরম তেলে ভাল করে ভাজলেই তৈরি মুচমুচে আম পোস্ত বড়া। গরমের দিনে কাঁচা আমের উপকারিতা আর নতুন করে বলার কিছুই নেই। তাই পাতে থাকুক এটি…
আল হাচ চিকেন
****************
উপকরণ:
চিকেন ১ কেজি
পেঁয়াজ ৫/৬ টা লম্বা কুচানো
সান ড্রাইড লাউ বা আল হাচি এক বাটি (আমি টাটকা লাউ ব্যবহার করেছি এখানে, লম্বা লম্বা করে কাটা)
এক চা চামচ জিরা
সর্ষের তেল ৭/৮ টেবিল চামচ
১ বড় এলাচ
১ ইঞ্চি দারচিনি
৩ লবঙ্গ
৩ ছোট এলাচ
১ চা চামচ আদা রসুন বাটা
কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো দুই চামচ
হলুদ এক চা চামচ
২ চা চামচ মৌরি গুঁড়ো
১/২ চা চামচ আদা গুঁড়ো
সাজানোর জন্যে আমন্ড আর ধনেপাতা কুচি
পদ্ধতি:
রোদ্দুরে শুকানো লাউকে কাশ্মীরিরা বলে আল হাচ। এই আল হাচ কিনে রান্না করলে সেটিকে ফুটন্ত জলে বেশ কিছুক্ষণ ফুটিয়ে, জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। তারপর একটু হলুদ দেওয়া ফুটন্ত জলে চিকেন দিয়ে ঢাকা দিয়ে দু-মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে চিকেন তুলে জলটা ফেলে দিতে হবে। এই চিকেন ভাল করে সর্ষের তেলে ভেজে রাখতে হবে। তারপর ওই তেলে জিরে, বড় এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ দিয়ে দিতে হবে। তাতেই ভাজা হবে পেঁয়াজ। পেঁয়াজ রঙ বাদামি হয়ে এলে আদা-রসুন বাটা দিতে হবে। এরপর একটু জল ছিটিয়ে তাতে দিতে হবে লঙ্কাগুঁড়ো, জলের ছিটা দিয়ে কষতে থাকাকালীন ভাজা চিকেন, আর লাউ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। সঙ্গে যাবে এক চামচ হলুদ আর আদা গুঁড়ো, মৌরি গুঁড়ো। ভাল করে নেড়ে প্রেসার কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে তিন চার মিনিট রান্না হলেই রেডি, আল হাচ চিকেন। সাজাতে হবে আমন্ড কুচি আর ধনেপাতা কুচি দিয়ে।
আসল রেসিপির শুকনো লাউ এখন সহজলভ্য, নইলে টাটকা লাউ দিয়েও করা যেতে পারে। লাউ যেহেতু পেট ঠান্ডা করে, গরমের দিনে মাংস হজমে সহায়তা করবে।
শিরমল
********
উপকরণ:
৩ কাপ ময়দা
১ কাপ দুধ
২ টেবিল চামচ চিনি
১ চামচ জাফরান
নুন আধ চা চামচ
ইস্ট এক চামচ
১/২ চামচ বেকিং সোডা
গোলাপ জল ২ টেবিল চামচ
ডিম ১ টা
সাজানোর জন্য বাদাম বা তিল
পদ্ধতি:
চিনিতে দু চামচ ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে তাতে ইস্ট গুলে রাখতে হবে, যাতে ফেঁপে ওঠে। ময়দা আর নুন মিশিয়ে তাতে একে একে সোডা, ইস্ট মিশ্রণ, উষ্ণ গরম দুধ, ভেজানো জাফরান , ঘি আর গোলাপ জল দিয়ে ভাল করে মেখে নিতে হবে। এই ময়দা মাখাটা ভিজে কাপড় ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে দুই ঘণ্টা। এর থেকে আটটা লেচি কেটে সেটাও রেখে দিতে হবে ১৫ মিনিট। তারপর রুটির মত বেলে নিয়ে, ওপরে একটু ডিম জাফরান জল মিশিয়ে ব্রাশ করে, ২০০ ° C এ বেক করতে হবে ১০ মিনিট, যাতে ওপরটা বাদামি হয়। এটা বিকেলের চা কফির সঙ্গেও যেমন ভাল লাগে, তেমনি স্বাদ লাগে কাবাব বা ভাল কারির সঙ্গেও।
আম শাহি টুকরা
***************
উপকরণ:
পাঁউরুটি ৩ স্লাইস ( তিন কোনা করে কাটা)
ভাজার জন্য ঘি বা সাদা তেল
গুঁড়ো দুধ ১/২ কাপ
পাকা আম এর পিউরি ১/২ কাপ
চিনি এক টেবিল চামচ
সাজানোর জন্য ড্রাই ফ্রুট কুচানো
পদ্ধতি:
পাঁউরুটি মুচমুচে করে ভেজে রাখতে হবে। এরপর ঘন করে গুঁড়ো দুধ আর চিনি গুলে কম আঁচে বসিয়ে একটু ফুটিয়ে নিতে হবে। চিনি গুলে গেলে দিতে হবে আমের পিউরি। আঁচ থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা হলে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে কিছুক্ষণ। তারপর সার্ভ করার প্লেটে পাঁউরুটি ভাজা রেখে তাতে আম ক্ষীর দিয়ে ওপরে ড্রাই ফ্রুট দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা…
এই রইলো কিছু নোনতা মিষ্টি রান্না। উৎসবের দিন ভরে উঠুক আনন্দেতে.. নতুন জামায় সেজে উঠুক ময়না পাড়ার মেয়ে এবং সব্বাই…
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।